স্বদেশ ডেস্ক:
দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কেনাকাটার প্রস্তাবে দামের অসামঞ্জস্যতা কাটছে না। চলমান প্রকল্পের তুলনায় এ সবের দামের ব্যবধান অনেক বেশি। যার কারণে প্রকল্পের খরচ দ্বিগুণেরও বেশি হচ্ছে। তিতাস গ্যাসের অপচয় ও সিস্টেম লস কমাতে প্রিপেইড মিটার প্রকল্প প্রস্তাবনায় এসব অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েছে। মিটারের দাম ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৬০০ টাকা। যেখানে তিতাসের চলমান প্রকল্পে প্রতি মিটারের দাম ১৭ হাজার ৮০০ টাকা। আর সমাপ্ত প্রকল্পে দাম ছিল ১২ হাজার ৯০০ টাকা। ফলে এখানে দামের ব্যবধান ১১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৭০০ টাকা। অন্য দিকে, রেগুলেটর ধরা হয়েছে প্রতিটির আমদানি খরচ ৯ হাজার টাকা। এটা আমদানি না করে দেশের মানসম্পন্ন পণ্য কেনার জন্য বলেছে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগ। তারা বাজার দরের সাথে যাচাই করে প্রাক্কলন এবং বাজার দরের তালিকা দেবার জন্যও বলেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের দেয়া প্রস্তাবনা এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (টিজিটিডিসিএল) তথ্য বলছে, ভবিষ্যৎ জ্বালানি সঙ্কট নিরসনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাসের কার্যকর ব্যবহার সরকারের প্রধান নীতিগুলোর একটি। বর্তমানে বিদ্যমান সিস্টেমে আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস অপচয় হচ্ছে। এ ছাড়া, কিছু অসৎ গ্রাহক অননুমোদিত সরঞ্জামের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারের সাথেও জড়িত। এটি প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় এবং সিস্টেম লসের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রিপেইড গ্যাস মিটার ব্যবহার করে গ্যাসের দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আবাসিক খাতে গ্যাসের অপচয় রোধ করে সিস্টেম লস হ্রাসকরণ সম্ভব হবে। যা দেশের জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। আর এই জন্য মোট ৩ হাজার ৯৫১ কোটি ৬ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়নে গ্যাস সেক্টরের দক্ষতা উন্নয়ন এবং জলবায়ু প্রশমন প্রকল্প (প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন) প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে জিওবি খাতে ১ হাজার ২০৯ কোটি ৮০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, বৈদেশিক অর্থায়ন ২ হাজার ৭১৯ কোটি ১৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা এবং নিজস্ব অর্থায়ন ২২ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে পাঁচ বছরে আগামী ৩০ জুন ২০২৮ সাল মেয়াদে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মোট গ্রাহকের কত শতাংশ প্রিপেইড গ্যাস মিটারের আওতায় আনা সম্ভব হবে সে বিষয়ে পিইসিকে টিজিটিডিসিএলের ব্যবস্থাপক জানান, বর্তমানে কোম্পানির আওতাধীন আবাসিক গ্রাহক সংযোগ সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৬৩ হাজার। এডিবি ও জাইকার অর্থায়নে ইতোমধ্যে স্থাপিত প্রিপেইড মিটারের সংখ্যা মোট ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে এডিবির টাকায় ৮ হাজার ৬০০টি এবং জাইকার টাকায় ৩ লাখ ২০ হাজারটি। জাইকার ঋণে সহায়তায় চলমান প্রকল্পটির আওতায় আরো এক লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের লক্ষ্যে আরডিপিপি সম্প্রতি অনুমোদিত হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে ১১ লাখ প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপনের মাধ্যমে টিজিটিডিসিএলের মোট গ্রাহকের প্রায় ৪১.৩০ শতাংশ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারিং সিস্টেমের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
মিটারের দর সম্পর্কে টিজিটিডিসিএলের ব্যবস্থাপক জানান, প্রস্তাবিত ডিপিপিতে মিটারের ব্যয় প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে জালালাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি: (জেজিডিএসএল) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ৫০ হাজার প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের গত ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সম্পাদিত মিটারের চুক্তি মূল্যের সাথে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্য ধরা হয়েছে। চুক্তি মূল্যটি ছিল ১৫ হাজার ৮৭৩ টাকা। জেজিডিএসএলের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মিটারটি ব্যবহারযোগ্য।
এ দিকে, চলমান ও প্রস্তাবিত অন্যান্য সমজাতীয় প্রকল্পের প্রিপেইড গ্যাস মিটারের ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের বিষয়ে আলোচনা করে পরিকল্পনা কমিশন। টিজিটিডিসিএল কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিপিপিতে মিটার প্রতি ব্যয়ের ২৯ হাজার ৬০০ টাকার সাথে টিজিটিডিসিএল কর্তৃক চলমান ‘প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন (৩য় সংশোধিত)’ প্রকল্পের মিটার প্রতি ব্যয় ১৭ হাজার ৮০০ টাকা। সমাপ্ত অপর একটি প্রকল্পের মিটার প্রতি ব্যয় ১২ হাজার ৯০০ টাকা যাতে উল্লেখযোগ্য তারতম্য রয়েছে। এ ছাড়া, সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লি: কর্তৃক প্রস্তাবিত স্মার্ট প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের ডিপিপিতে মিটার প্রতি ব্যয় ২৬ হাজার টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। চলমান বা প্রস্তাবিত প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ব্যয়ের তারতম্য নিরসনকল্পে স্মার্ট প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন বিষয়ক একটি স্ট্যান্ডার্ড সিস্টেম ডিজাইন এবং রেট শিডিউল প্রণয়নের জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য শিল্প ও শক্তি বিভাগে অনুষ্ঠিত পিইসি সভা থেকে বলা হয়েছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রজেক্ট লাইফ ১৫ বছর এবং প্রযুক্তিগত স্পেসিফিকেশন জি ডিজাইন জীবন ১০ বছর ধরা হয়েছে। যা পেট্রোবাংলার অধীনে চলমান এবং প্রস্তাবিত অন্যান্য সমজাতীয় প্রকল্পের প্রিপেইড মিটারের প্রজেক্ট লাইফ ও ডিজাইন লাইফের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পেট্রোবাংলার অধীনে চলমান সমজাতীয় অপর একটি প্রকল্প টিজিটিডিসিএল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন (৩য় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পে প্রিপেইড গ্যাস মিটারের প্রজেক্ট লাইফ ২০ বছর এবং মিটার প্রতি মাসিক রেন্ট ১০০ টাকা নির্ধারণ করা রয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে গ্রাহক পর্যায়ে নির্ধারিত মাসিক মিটার রেন্ট ২০০ টাকা ধরা হয়েছে। চলমান অন্যান্য প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান মাসিক মিটার রেন্ট ১০০ টাকা। এর তুলনায় দ্বিগুণ নির্ধারণ করা যৌক্তিক নয়।
পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগ বলছে, প্রিপেইড মিটার স্থাপনের ক্ষেত্রে টিজিটিডিসিএলের পূর্বাভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা থাকা রয়েছে। ফলে পরামর্শক সেবা খাতে ৭৯৮ জনমাসের যৌক্তিক নয়। এটাকে যৌক্তিক পর্যায়ে কমাতে হবে। সে অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করতে হবে। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) আবদুল বাকীর কাছে মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, পিইসি সভায় আমাদের কিছু অবজারভেশন ছিল। সেগুলো তাদেরকে বলা হয়েছে। সেই আলোকে প্রকল্প সংশোধন করে আবার পাঠাতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, সেখানে ক্রয়ের সাথে সম্পর্কিত কিছু থাকলে আমরা তা বাজারের দরের তালিকা দেবার জন্য বলি।